হাইপারএসিডিটি (Hyperacidity)’র কারণ, লক্ষণ ও আপদকালীন স্ব-সহায়িকা!
“হাইপারএসিডিটি (Hyperacidity)”
হাইপারএসিডিটি বলতে মূলত পাকস্থালিতে ‘অতিরিক্ত পরিমানে এসিড নিঃস্বরণকে’ নির্দেশ করা হয় । পাকস্থালি নিঃসরিত রস খাদ্য উপাদানকে ছোট ছোট এককে ভেঙে হজমের উপযোগী করে তোলে। পাকস্থালি তার সমান গঠনের জিনিসগুলো হজম করতে পারে । এই হজম প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য পাকস্থালিতে অনেক ধরণের গ্যাস্ট্রিক জুস উৎপন্ন হয়। সেই জুস গুলো অতিমাত্রায় এসিডিক।
পাকস্থালির অভ্যন্তরে লাইনের (বর্ডারে) সাথে অসংখ্য cell (কোষ) থাকে পাকস্থালির এই কোষগুলো পেপসিনোজেন এনজাইম সরবরাহ করে যা পরবর্তীতে পেপসিন হয়ে প্রোটিন হজম করতে সহায়তা করে। কিছু কোষ এই পেপসিনোজেন সরবরাহ করে, এবং কিছু কোষ হাইড্রোক্লোরিক এসিড সরবারাহ করে। কোষগুলো নিজেরাও প্রোটিন কিন্তু এই কোষগুলো ইনেক্টিভ পেপ্সিনোজেন ও হাইড্রোক্লোরিক এসিডে সরবরাহ করে। সেই পেপ্সিনোজেন গুলো যখন হাইড্রোক্লোরিক এসিডের সস্পর্শে আসে তখন সেইগুলো এক্টিভ হয়ে পেপসিন হয়ে প্রোটিন হজম করতে সহায়তা করে। ইনেক্টিভ পেপসিনোজেন বিক্রিয়া করতে অক্ষম। তাই স্বাভাবিক অবস্থায় উচ্চমাত্রার এই এসিডগুলো পাকস্থালির কোষগুলোর কোন ক্ষতি করে না।
আরো দুইভাবে পাকস্থালির এই কোষগুলো নিজেদের রক্ষা করে।
প্রথমত, বাইকার্বোনেট সিক্রেশন – যা পাকস্থালির উচ্চমাত্রার এসিড সিক্রেশনকে সামাব্যস্থায় রাখতে সাহায্য করে। কোষ দ্বারা মিউকাস লেয়ারে একধরণের আবরণ সৃষ্টি হয়। এই আবরণগুলোই পাকস্থালি লাইনে (বর্ডার) অবস্থান করে ও সুরক্ষা দেয়। Pepsin, Hydrochloric Acid, Protective Mucus, Bicarbonate এই গ্যাস্ট্রিক জুস গুলোর সামাব্যস্থায় উৎপাদন হলেই সেই পাকস্থালিকে সুস্থ পাকস্থালি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পেপটিক আলসারের মতো রোগ তখনই হয়, যখন পাকস্থালি নিজেই নিজের কোষ গুলো খাওয়া শুরু করে।
Stomach Ulcer হওয়ার অন্যতম কারণ:
Stomach Ulcer হওয়ার অন্যতম কারণ Bacteria Helicobacter pylori । গবেষণায় দেখা গেছে ৭০ শতাংশ Stomach Ulcer এর কারণ Bacterium.
Non-steroidal inflammatory drug (NSAIDs), Aspirin, Ibuprofen and naproxen এই জাতীয় ওষুধগুলো এর অন্যতম বড় কারণ এবং এই ড্রাগস গুলো মিউকাস দিয়ে গঠিত সুরক্ষা স্তর গুলো নষ্ট করে দেয়। তখনই পাকস্থালি তার নিজের কোষগুলো খাওয়া শুরু করে।
আয়ুর্বেদের ভাষায় Hyperacidity কে ‘অম্লপিত্ত’ বলে। যদি এই ‘অম্লপিত্তা’ বুঝতে হয় তাহলে প্রথমে বুঝতে হবে অগ্নি কি? অগ্নি বলতে আমরা বুঝি আগুনের কথা। আমাদের শরীর “পঞ্চমহাভুতা” দিয়ে গঠিত। তার মধ্য অগ্নি অন্যতম। আয়ুর্বেদের ভাষায় অগ্নিকে বর্ণনা করা হয় “Fire of life” বলে। সাধারণ ভাষায় অগ্নি হল সেই শক্তি যা শরীরে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় সহায়তা করে।
স্বাস্থ্য ও রোগের মাঝে ভারসাম্য রক্ষায় অগ্নির গুরুত্ব অনেক, স্বাভাবিক অগ্নি নির্দেশ করে ‘সুস্থ শরীর’ আর অস্বাভাবিক অগ্নি নির্দেশ করে ‘রোগাক্রান্ত’ শরীর।
সময়, পরিবেশ, ঋতু কাল ভেদে শরীরের Sense Organ গুলো ভিন্ন ভিন্ন আচরণ শুরু করে। একই সময়ে বিপরীত গুণ ধর্মী কোন খাদ্যের সংস্পর্শ আসলে অগ্নি তার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া থেকে চ্যুত হয় এতে অনেকাংশে সময়, পরিবেশ, ঋতু কাল এর পরিবর্তনও দ্বায়ী।
পাকস্থালিতে অগ্নি সরবারাহের ক্ষেত্রে কোন অগ্নি না থাকাও (মন্দ অগ্নি) যেমন সমস্যার তেমনি বেশি পরিমানে (তীক্ষ্ণ ) অগ্নি থাকাও সমস্যার, কারণ দুই অবস্থাতেই পাকস্থালির (Digestive Power) হজম ক্ষমতা থাকে না ও পাকস্থালি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তীক্ষ্ণ অগ্নির ফলে ঘটা ঘটনাই হল Hyperacidity বা অম্লপিত্তা।
Ø প্রতিরোধের জন্য নিজস্ব করণীয় ও স্ব-সহায়িকাঃ
১। এটা পরিস্কার যে, তীক্ষ্ণ অগ্নির প্রভাব বাড়ার কারণে মূলত হাইপারএসিডিটি হয়। তীব্র মাত্রায় টক জাতীয় খাবার বা অ্যালকোহল, লবন, গরম এবং তীক্ষ্ণ প্রকৃতির খাদ্য খাওয়া বন্ধ করতে হবে। রাগ এবং ভয় এর অতিরিক্ত মাত্রায় ধারণ বা প্রকাশ করা সাথে তীক্ষ্ণ অগ্নির যোগসূত্র রয়েছে। তাছাড়া তীব্র সূর্যের আলোতে বের হওয়া, খাদ্য গ্রহণে অনিয়মিত অভ্যাস তীক্ষ্ণ অগ্নির বৃদ্ধি করে।
২। নিয়ম অনুযায়ী, তীক্ষ্ণ অগ্নি থাকা অবস্থায় খুব ভালো করেই দুধ খাওয়া যায়। তবে মাঝে মাঝে দুধ হজমে সমস্যা করে কারণ বেশি পরিমানে এসিডের প্রভাব এর ফলে দুধের প্রোটিনের সাথে এসিড মিলে শক্ত দই বানিয়ে ফেলে। সচরাচর এসব অবস্থায় পুরোটা বমি হয়। তবে দুধ নিঃসন্দেহে বেশি পরিমাণে এসিড থাকার সময় দুর্দান্ত খাবার । সেক্ষেত্রে এটা খালি পেটে গ্রহণ করলে বেশি ভাল। এসিডিটির (অম্লপিত্তা) প্রভাব কমাতে হলে দুই চা চামচ ঘি হালকা গরম দুধের সাথে মিশিয়ে খেতে হবে।
৩। কিছু কিছু সময়, আধা চিবিয়ে খাবার খেতে হবে। চিবিয়ে খাবার খেলে স্বাভাবিক ভাবেই গ্যাস্ট্রিক জুসের নিঃস্বরণ বাড়ায়। আধা চিবিয়ে খেলে পর্যাপ্ত গ্যাস্ট্রিক জুস নিঃস্বরণ না হওয়ার কারণে পূর্বের থাকা অতিরিক্ত এসিডকে সাথে মিলে খাবার হজম করবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে আধা চিবিয়ে খাবার শুধুমাত্র নির্দিষ্ট অবস্থার জন্য ভালো৷
৪। এইসব অবস্থায় কখনোই অতিরিক্ত খাওয়া উচিত না৷ তবে অল্প করে দিনে তিনবার খাবার গ্রহণ করতে হবে। ঐসব
মুহুর্তে রুচি না থাকলে রুচি বাড়ানোর জন্য কৃত্রিম উপায় অবলম্বন করা যাবে না। এই অবস্থায় যেকোন ভাবে যুক্ত অ্যালকোহলিক খাবার খাওয়া মানে আগুনে পেট্টোল দেওয়া। বেশি পরিমাণে চা এবং কফিতে থাকা ক্যাফেইন এসিড সিক্রেশন বাড়ায়।
৫। অতিরিক্ত মিষ্টি খেলে পাকস্থালিতে এসিড সিক্রেশন বেড়ে যায়। নির্দিষ্ট করে, যদি ভুল কম্বিনেশনে খাবার খাওয়া হয়।
৬। লবন, তৈল, আচার, দই, ভাজা পোড়া, টক জাতীয় খবার যেমন তেতুল, যেসব খাবার শরীরের তাপমাত্রা বাড়ায় এসব খাবার খাওয়া যাবে না৷
৭। হাইপারএসিডিটির সময় মধুর, তিক্ত, কষা জাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে। এবং কি ধরণের ডায়েট উপযুক্ত সেজন্য অবশ্যই কোন অভিজ্ঞ আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক এর পরামর্শ গ্রহণ করুন।
৮। আয়ুর্বেদিক Avipattikara Choorna এসিডিটির কারণে সৃষ্ট কারণ সমূহের ক্ষেত্রে একটি কার্যকরী পথ্য। এই পথ্যটি ৩ থেকে ৬ গ্রাম করে গরম পানির সাথে মিশিয়ে খাবার আগে বা মাঝে গ্রহণ করতে হবে।
৯ । এক বছরের পুরনো চাল, পুরানো ডাল , আটা, দুধ, সবুজাভ শাকসব্জী, যেসব ফল মিস্টি রস সরবারাহ করে এসকল খাদ্য গ্রহণ করতে পারবেন। এবং ডাল জাতীয় খাবার পরিমিত পরিমাণে খাওয়া যাবে।
১০। ডাবের পানি এসব অবস্থায় খুবই কার্যকরী।
১১। আমলকি এর পাউডার দুই চামচ করে দিনে তিনবার নিলে সেটা কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে।
Writer
Md. Khairul Bashar (Naeeim)
Bachelor of Ayurvedic Medicine & Surgery (BAMS) Student, National Institute of Ayurveda (Deemed to be University), Jaipur, Rajasthan.