আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা দর্শনঃ পর্ব ২
পঞ্চ মহাভুত সিদ্ধান্তঃ
যা আছে ভান্ডে, তা আছে বিশ্বভ্রক্ষ্মান্ডে। মানে স্রষ্টা এই পৃথিবী যেসকল উপাদানে তৈরি করেছেন মানব শরীর ও সেই উপাদানে তৈরি করেছে। আমাদের মহাবিশ্ব ১) আকাশ, ২) বায়ু, ৩) আগুন, ৪) পানি ও ৫) মাটি এই পাঁচটি ভৌত উপাদানে গঠিত।
উদাহরণ সরূপ, উদ্ভিদ ও প্রাণী জগতের একক কোষ ও এই পাঁচটি উপাদানে গঠিত। বাহ্যিকভাবে এদের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা না গেলেও আভ্যন্তরীণ কর্মে এদের অস্তিত্ব নিরূপণ করা যায়। যেমনঃ
১) আমাদের শরীরের গঠন গত একক হলো কোষ, কোষে ফ্রি স্পেস ( শুন্য জায়গা) আছে যা আকাশের সাথে সাদৃশ্য।
২) কোষের ভিতরের অংগানুগুলো (cellular organ) এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যায়।, movement / চলাচল হলো বায়ুর বৈশিষ্ট্য।
৩) কোষের মধ্যে সব সময় ক্রিয়া বিক্রিয়া ঘটে (cellular metabolism). এবং নতুন কিছু তৈরি হয়। যা আগুনের বৈশিষ্ট্য।
৪) কোষের মধ্যে সাইটোপ্লাজম থাকে যা তরল। যা পানির বৈশিষ্ট্য।
৫) কোষকে ধারণ করে আছে প্লাজমা মেমব্রেন। যা আসলে মাটির বৈশিষ্ট্য।
এইভাবে সারা শরীর গঠিত। আমাদের প্রত্যেকের শরীরেই এই ৫ টি উপাদান কম বেশি আছে। কারো আগুন বেশি থাকলে সে খুব সহজেই রাগান্বিত হয়ে যায়। কারো বায়ু বেশি থাকলে সে এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে থাকতে পারে না এবং মন খুব দ্রুত অস্থির হয়ে যায়। আবার কারো মাটি ও পানি বেশি থাকলে সে সহজ এ রাগে না। তার শরীর থাকে ঠান্ডা।
শুন্যস্থান ছাড়া বায়ু চলাচল করতে পারে না, তাই যেখানে শুন্যস্থান বা আকাশ থাকে সেখানেই বায়ু থাকে।
১) আকাশ ও বায়ুকে একসাথে আয়ুর্বেদ এর বলে বাত (vata)।
২) আগুনের বৈশিষ্ট্যকে বলে পিত্ত (pitta) ।
৩) পানিকে রাখার জন্য অবশ্যই ধারক দরকার। পানিকে ধারন করে মাটি। তাই যেখানে পানি সেখানে মাটি থাকবেই। এই পানি ও মাটি কে একসাথে বলে কাফ (kappa)
এই বাত, পিত্ত, কাফকে বলা হয় ত্রিদোষ। এই ত্রিদোষ দ্বারা মানব দেহ গঠিত। ত্রিদোষের পরিমানের তারতম্যের কারণে মানুষের ও প্রকৃতিগত তারতম্য ঘটে।
যেমন বায়ুর গুণ হল প্রবাহ (movement), রুক্ষতা (dryness), হালকা ( lightness), সুক্ষতা ( minuteness), ঠান্ডা (coldness), খরতা (খসখসে/ roughness)। উদাহরণ সরূপ বলা যায় যার মধ্যে বায়ু বেশি সে খুব দ্রুত হাঁটবে, দ্রুত একটা জিনিস শিখতে পারে কিন্তু খুব দ্রুত ভুলে যাবে, তারা স্থির হয়ে এক যায়গায় থাকতে পারে না, সর্বদা নড়াচড়া করবে, এবং মনের অস্থিরতা খুব বেশি কাজ করবে, তাদের শরীরের চামড়া শুষ্ক হবে, নোখ দিয়ে টান দিলেই দাগ পড়বে, ঠোঁট ও পা অল্প শীতেই ফেটে যাবে, বায়ু ভারসাম্যে না থাকলে পায়খানা শুষ্ক হবে ইত্যাদি।
পিত্ত এর বৈশিষ্ট্য তীক্ষ্ণ, উষ্ণ, হাল্কা, চল ইত্যাদি। ব্যবহারিক ক্ষেত্রেও শারীরিক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন যাদের পিত্ত বেশি তারা সহজেই রেগে গিয়ে কথা দ্বারা আঘাত করার চেষ্টা করে কিন্তু আবার খুব তাড়াতাড়ি ঠান্ডা হয়ে যায়, শরীর স্বাভাবিক থেকে একটু গরম থাকে, খাবার দ্রুত হজম হয় ও দ্রুত ক্ষুধা লাগে, উষ্ণতা ও তৈলাক্তকতার কারণে মুখে ব্রন হয়, খুব দ্রুত পরিস্থিতির সাথে মানাতে পারে ইত্যাদি।
কাফ এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে স্নিগ্ধ, শীত, গুরু, মন্দা, মসৃন, উজ্জ্বল, স্থির ইত্যাদি। শরীরের স্নিগ্ধতা বা পিচ্ছিলতা বেশি হবে, অল্পতেই ঠান্ডা লেগে যাবে, হাত পা ঠান্ডা থাকবে, শ্বাস কষ্ট থাকতে পারে, আকারে ভারী বা মোটা হবে বিশেষ করে বুক চওড়া হবে, খুব ধীরে কাজ করবে, অনেক বেশি ইমোশোনাল হবে ও অল্পতেই কষ্ট পাবে, অতিরিক্ত ঘুম পাবে, কোন জিনিস বুঝতে একটু সময় লাগবে কিন্তু যে জিনিস বুঝবে খুব গভীরভাবে উপব্ধি করবে, নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকবে, রোগ কম হবে ও মনে স্থিরতা থাকবে ইত্যাদি।
আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা দর্শনে এই পঞ্চ মহাভুত তত্ত্ব এর বিশেষ ভূমিকা পালন করে। যেহেতু সৃষ্টির সব কিছু এই পঞ্চ মহাভুতে গঠিত প্রতিটা দ্রব্য আমরা যা খাই, আমরা যা ভেষজ হিসাবে নেই সবকিছুর ভিত্তি এই পঞ্চমহাভুত তত্ত্ব। পঞ্চ মহাভুতের শরীরে যখন ব্যালেন্স নষ্ট হয় তখনই রোগের উৎপত্তি হয়। আহার, ভেষজ এবং জীবন – বিধানের মাধ্যমে পঞ্চ মহাভুতের ভারসাম্যহীনতাকে ভারসাম্যে নিয়ে আসা ই প্রকৃত চিকিৎসা।
মধুর রসে পৃথিবী এবং জল উপাদান বেশি থাকে, অম্ল রসে পৃথিবী এবং অগ্নি উপাদান বেশি থাকে, লবণ রসে জল এবং অগ্নি উপাদান বেশি থাকে, তিক্ত রসে বায়ু এবং আকাশ উপাদান বেশি থাকে, কটু রসে বায়ু এবং অগ্নি উপাদান বেশি থাকে, কষায় রসে বায়ু এবং পৃথিবী উপাদান বেশি থাকে।
আধুনিক নিউটনিয়ান বিজ্ঞান অনু, পরমানু পর্যন্ত গবেষনার গভীরতা অর্জন করতে পেরেছে, কিন্তু শক্তি স্তরে আয়ুর্বেদ বিরাজমান। আমরা সবাই একই শক্তির বিভিন্ন রূপ তা কোয়ান্টাম পদার্থ বিজ্ঞানীরা অনেক আগেই প্রমান করেছেন। আয়ুর্বেদ এর চিকিৎসা অনেক সুক্ষ্ম স্তরে তাই রোগের মুল উৎপাটন সম্ভব, কিন্তু আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান শুধুমাত্র সিম্পটম এর চিকিৎসা করে, কারণ স্তরে এই বিজ্ঞান পৌছাতে পারে না বলেই রোগ এক স্তর থেকে অন্য স্তরে বিচরণ করে অথবা এক রোগ থেকে অন্য রোগে পরিবর্তিত হয়ে ভয়াভয় আকার ধারণ করে।
About Author
Bachelor of Ayurvedic Medicine and Surgery
National Institute of Ayurveda, Jaipur, Rajasthan